অবশেষে পরিণতি পেলো ঋজু আর রিনির তিন বছরের সম্পর্কটা । বিয়ে হলো ওদের। ঢাকা শহরে এই প্রথম এসেছে ওরা। রিনির চাচা বার বার নিমন্ত্রন জানাচ্ছিলেন। সচিবের পদে অধিষ্ঠিত একজন প্রতাপশালী মানুষের অনুরোধ উপেক্ষা করার বোকামী এই যুগে কেউ করে না। সবার এখন কানেকশন দরকার। ওরাও করলো না। কিন্তু সমস্যাটা বেঁধে গেলো ঠিকানাটা নিয়ে। মফস্বল থেকে আসা এক দম্পতির ঢাকা শহরের এত্ত পাহাড়সম অট্টালিকার মাঝে একজন মানুষের বাসস্থান খোজ করাটা যথেষ্ট উদ্বেগের। অবশেষে একটি আঠার তলা ভবনের সামনের এসে ওদের রিক্সা থামলো। ঋজু ভেতরে যেতে ইতস্তত করলে রিনি বললো, একবার যেয়ে দেখতে ক্ষতি কোথায় ? চল তো? ভেতর ঢুকে এতো বিশাল একটা নির্মাণ, অথচ কোথাও প্রাণের স্পন্দন পেলো না ওরা । কিন্তু সামনের লিফটের সুইচে হলুদাভ আলো জ্বলছে । অর্থাৎ লিফট ব্যবহার করা যাবে। রিনি তেমন কিছু না চিন্তা করে জি বাটনে চাপ দিলো। কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই লিফট গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসে খুলে গেলো। ভেতর টা শূন্য, খা খা করছে। ঋজু আর রিনি আগে মাত্র দুই একবার লিফটে উঠেছে। তাই দুজনে খুব সংকোচের সাথে লিফটে উঠলো। ওদের সাথে যে ঠিকানাটা ছিলো সেখানে আঠার তলা ভবনের পনেরতম তলার একটা ফ্ল্যাটের কথা বলা ছিলো। তাই রিনি পনের সংখ্যাটার বাটনে চাপ দিলো। চাপ দেবার আগ মুহুর্তে কিছু একটা যেন আটকে দিতে চাচ্ছিল ওর হাতটা। বাতাস যেন ফিসফিসিয়ে অচেনা ভাষায় কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল ওর কানে। রিনি থেমেও থামতে পারলো না। চাপ পরে গেল নাম্বার প নের বাটনে। লিফট হালকা একটা ঝাঁকি দিয়ে উপরের দিক উঠতে শুরু করলো। ফাকা লিফটে নতুন বউকে এতো কাছে পেয়ে ঋজু সুযোগ সদ্ব্যবহার করতে চাইলো। রিনি চোখ পাকিয়ে শাসালো, যার মানে একদম এসব চিন্তা করো না। কিন্তু ঋজুর ঠোঁট টা অনেকটাই চলে এসেছে রিনির ঠোটের কাছে। মুহুর্তে ব্যবধানে ওরা এক দীর্ঘ চুম্বন সৃষ্টি করবে। ঠিক সেই মুহূর্তেই প্রচন্ড এক ঝাকিতে লিফটটা থেমে গেলো। নিভে গেলো লিফটের যান্ত্রিক আলো। দুজনে ঘটনার আকস্মিকতায় ভঁয়ে একে অপরকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। নিরাভরণ অন্ধকারে ঋজুর চুমুটা অসমাপ্ত রয়ে গেলো ।
ঋজু নিজেও ভেতরে ভেতরে খানিকটা ঘাবড়ে গেলেও রিনিকে সাহস যোগানোর চেষ্টা করলো। বললো, ভয় পেও না। বিদ্যুৎ চলে গেছে। এই কিছুক্ষণের মধ্যে এলো বলো।একজোড়া নব্য বিবাহিত ভবিষ্যতের রঙ্গিন স্বপ্নে বিভোর দম্পতি লিফটের কালো অন্ধকারে বন্দী অবস্থায় পরে আছে প্রায় দশ ঘন্টা কেটে গেল। ওদের শত গলা ফাটানো চিৎকার, হাহাকার শোনার জন্য একটা মানুষ অতি আশা, যেন একটা পতঙ্গও নেই। আমাদের বিভিন্ন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা সাধারণ মানুষের কাছে নরকের বর্নণা এমনভাবে উপস্থাপন যেন উনারা ঐখানে হলিডে প্যাকেজে কিছুদিন কাটিয়ে এসেছেন। রিনির এক মুহুর্তে মনে হলো ওদের যদি কেউ আজ এভাবে বন্দী হত তাদের, বুঝত নরকের সংজ্ঞা। মনে হচ্ছে এই গোটা পৃথিবীটা হলো শুধু এই অন্ধকার বাক্সটা আর সেখানে ওরাই দুজন মাত্র জীবন্ত মানুষ। অথচ ওদের থেকে মাত্র কয়েক পদের দূরত্বে দেড় কোটি মানুষের কোলাহলে ডুবে আছে এই শহর। এভাবে কেটে গেলো আরও চারটি ঘন্টা। আচ্ছা এতোবড় ভবনে কেউ কি নেই? একটা মানুষও কি থাকবে না? এটা কিভাবে হয়? ঋজুর মাথায় এইসব প্রশ্ন ঘুরপাক করতে করতে সে ব্যাগ থেকে পথে কেনা বিস্কিটের প্যাকেট আর জলের বোতল বের করে রিনি দিকে এগিয়ে দিলো। বোতলে জলও বেশি অবশিষ্ট নেই। বিস্কিট টা না খেলেও জলের বেশিরভাগ খেয়েছিলো ওরা যাত্রাপথে। বিস্কিট আর জল টা রিনি দুজনের মাঝে ভাগ করে নিলো। আর মেয়েরা সংসারে অন্যকে বেশি দেবার যে সহজাত প্রবৃত্তি জন্ম নেই হয়তো সেখান থেকেই ঋজুকে বেশি দেবার চেষ্টা করলো।
সহ্যের শেষ সীমায় পৌছে গেছে ওরা। দীর্ঘ চুয়াল্লিশ ঘন্টা এই পাঁচ বাই ছয়ের অন্ধকার ঘরে আবদ্ধ থেকে নতুন এক যন্ত্রনা গভীরতাকে চিনতে শিখেছে যার সম্পর্কে এতদিন শুধু শুনেছিলো ওরা। আর সেটি হলো ক্ষুধা। তীব্র এক অনুভূতি পেটের ভেতর যেন নাড়া দিয়ে যাচ্ছে বার বার। যেন কুন্ডলী পাকানো এক শূণ্যতা পেট থেকে চিঁড়ে নিজেকে বের করে দিয়ে চাইছে। বিখ্যাত আলোকচিত্রী কেলভিন কার্টার অপেক্ষমান শকুনের সামনের যে ক্ষুধার্ত এবং মৃতপ্রায় সুদানি শিশুটির ছবি তুলেছিলেন আজ সেই শিশুটির ছবি ভেসে উঠলো রিনির চোখের সামনে। আজ ছবিতে দেখা ঐ শিশুটির যন্ত্রনা প্রকৃত অর্থে যেন ছুয়ে গেলো, শুধু ওর হৃদয়ে নয়, ওর পাকস্থলীতেও। পার্থক্য শুধু ওদের সামনে যে শকুন অপেক্ষা করে আছে সেটা হলো এই নীরবতা আর গাঢ় অন্ধকার।
নিজের ব্যাগে থাকা জামাকাপড় সব শেষ হয়ে গেছে। বন্দী থাকার একশো বাইশ ঘন্টা পর ওরা এবার নিজেদের পরনের জামা কাপড় ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে শুরু করলো। মানুষ প্রেমে পাগল হয়, বিশ্বাস ঘাতকতায় হয়, একাকীত্বে হয় কিন্তু তারা যদি জানত ক্ষুধার মানুষকে কতখানি উন্মাদ করতে পারে, ক্ষুধার আঘাত একজনকে কতটা অসহায় করতে পারে তাহলে ঐ সব ঠুকনো কারণে প্রাণ বিসর্জনের স্বাদ ঘুচে যেত ওদের। কাপড়ের শক্ত তন্তু ছিঁড়ে খেতে খেতে দুজনের মাড়িতে আচড় পরে গেছে। চুইয়ে রক্ত বের হচ্ছে অল্প অল্প। কিন্তু ক্ষুধা ওদের ক্ষমা করছে না। যেন প্রতি মূহুর্তে ক্ষত-বিক্ষত করছে শরীরটাকে । আর চারিদিকে ওদেরই বিষ্ঠা ছড়ানো। বিকট গন্ধে যেন হৃৎপিণ্ড বুকের খাঁচা থেকে মুক্তির খোঁজ করছে। ব্যাগের জামা-কাপড় শেষ হয়ে গেলে নিজের পরনের কাপড় ওরা ছিঁড়ে খেতে শুরু করলো। অবশেষে দেহের অন্তর্বাস বাদ গেলো না। বড় ক্ষিদে, বড় যন্ত্রনা। কি নিষ্ঠুর এই অন্ধকার কাঠামোটা। একটু একটু করে মৃত্যুকে মেনে নেয়া ছাড়া, আত্নহত্যা করারও কোন উপায় নেই।
এই বদ্ধ নরকে ওরা আছে প্রায় সপ্তাহ হতে চললো। রিনি কয়েক ঘন্টা জ্ঞান হারিয়েছে। হয়তো আর জ্ঞান ফিরে নাও পেতে পারে। ঋজু এখনো নিজের শরীরের বিরুদ্ধে গিয়ে টিকে আছে। তবে জীবনী শক্তি প্রায় যে শূন্যের কোঠায় সেটা প্রতিটা নিঃশ্বাসে টের পাচ্ছে ও। মৃত্যুকে মেনে নেবার পরেও মানুষের মনে কোথাও না কোথাও বেঁচে থাকার একটা তীব্র বাসনা বার বার ভেরতটাকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। ঋজুও সেই তীব্র আখাংকাকে নিয়ে শেষ বারের জন্য ঈশ্বেরর কাছে প্রার্থনা করছিলো হঠাৎ ওর দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো রিনি মুখের উপর। চোখ নিচে কালি পরে গেছে। গুলো এলোমেলো চুল, নগ্ন দেহটা এলিয়ে পরে আছে। রিনির শরীরটাকে এভাবে দেখার পর ঋজুর সহ্য সব সীমা পার হয়ে যাওয়া খিদেটা লোভের রূপ নিলো। নিজেকে কোন ভাবে যেন নিয়ন্ত্রন করতে পারছে না । এতো বছরের প্রেম, বিয়ে, বন্ধন সবকিছু মুখ থুবড়ে পরেছে এই নরকের দেয়া যন্ত্রনার কাছে। নিজের নিয়ন্ত্রন শক্তি হারিয়ে ঋজু ওদের ট্রলি ব্যাগের উপরে বিজ্ঞাপন হিসাবে এটে দেয়া ধাতব এবং ধারালো একটা ট্যাগ খুলে নিয়ে একটু একটু করে রিনির কাছে এগিয়ে গেল। ঠিক সেই মূহুর্তে রিনি চোখ খুলে তাকিয়ে পরলো ঋজুর দিকে। কিন্তু ঋজু এতটুকু বিচলিত হলো না। একটা সামান্য পশুর মত ঝাঁপিয়ে পরলো রিনির উপর। নিজের সমস্ত শক্তিকে এক করে রিনি গলায় সেই ধারালো ট্যাগ দিয়ে একেক পর পর আঘাতে গলার নালী বের করে ফেলল। দুর্বল রিনির কোন প্রতিরোধ কাজে এলো না। শুধু মৃত্যু পূর্বে হয়তো নিজের ভালোবাসার, সতীত্বের, বিশ্বাসের এই প্রতিদানে কিছুটা অভিমান নিয়ে চোখ বন্ধ করেছিলো, অবশ্য সে খবর কেউ রাখেনি। তৃষ্ণায় গলাটা শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেছিলো এই নতুন পশুটার। তাই পেট ভরে আগে গলা থেকে রিনির রক্ত ঢোক ঢোক করে গিললো। তারপর গলার কাটা স্থান থেকে নরম মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে লাগল। কখনো ধারালো ধাতবের ব্যবহারে, কখনো হাতে দিয়ে টেনে ছিঁড়ে রিনির নরম শরীরটার মাংসের টুকরো গুলো পরম তৃপ্তির সাথে গিলতে লাগলো। এভাবে গলা, স্তন, উদর, যোনী, উরু কোন কিছুই বাদ গেলো না । এমন কি মাথাটা আলাদা করে গলার পথে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রিনির মাথার ঘিলু নাগাল পাবার অবিশ্রান্ত প্রচেষ্টাও সফল হলো মানুষ থেকে পশু হওয়া এই নতুন স্বত্বা । অবশেষে পরে থাকলো শুধু শুকিয়ে যাওয়া মুখখানা। টিস্যুগুলোর সংকোচনে মুখখানা কেউ কেউ দেখলে মনে করতো কোন মুখোশ পুরনো হয় গেছে। ক্ষুধার যন্ত্রনা আবার নাড়া দিলে হাড়ের কাঠামোতে কোন মতে টীকে থাকা এই পচন ধরা মুখটাকে চিবুতে শুরু করলো ঋজু। চিবুতে চিবুতে শেষ যখন শেষ অংশ গিলে ফেললো ঠিক সেই সময় জ্বলে উঠলো লিফটের আলো, একটা পরিচিত শব্দে খুলে গেলো লিফটের দরজা।
পরিশিষ্ট
পরে জানা যায় ঐ ভবনটি রিনির সচিব চাচার ভবনের পাশেই অবস্থিত। ভুলে করে ওরা এই ভবনে ঢুকে পরে। অবৈধ নির্মাণ হবার কারণে ভবনটি রাজউক ভেঙ্গে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। কিন্তু আইনি জটিলতা শেষ হতে আরও কয়েকদিন সময়ের প্রয়োজন হয়। বাসিন্দারা সবাই চলে গেলে যেদিন ভবনের বিদ্যুৎ বন্ধ হবার কথা দুর্ভাগ্যবশত সেইদিনই ঋজু আর রিনি ঢুকে পরে অভিশপ্ত লিফটে। ঋজু এখনো বেঁচে আছে। শুধু উন্মাদ হয়ে গেছে। শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়। এখনো মানুষের রক্ত আর মাংস খাওয়ার মাঝে মাঝে চিৎকার করে, প্রায়ই করে হাহাকার।
ঋজু নিজেও ভেতরে ভেতরে খানিকটা ঘাবড়ে গেলেও রিনিকে সাহস যোগানোর চেষ্টা করলো। বললো, ভয় পেও না। বিদ্যুৎ চলে গেছে। এই কিছুক্ষণের মধ্যে এলো বলো।একজোড়া নব্য বিবাহিত ভবিষ্যতের রঙ্গিন স্বপ্নে বিভোর দম্পতি লিফটের কালো অন্ধকারে বন্দী অবস্থায় পরে আছে প্রায় দশ ঘন্টা কেটে গেল। ওদের শত গলা ফাটানো চিৎকার, হাহাকার শোনার জন্য একটা মানুষ অতি আশা, যেন একটা পতঙ্গও নেই। আমাদের বিভিন্ন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা সাধারণ মানুষের কাছে নরকের বর্নণা এমনভাবে উপস্থাপন যেন উনারা ঐখানে হলিডে প্যাকেজে কিছুদিন কাটিয়ে এসেছেন। রিনির এক মুহুর্তে মনে হলো ওদের যদি কেউ আজ এভাবে বন্দী হত তাদের, বুঝত নরকের সংজ্ঞা। মনে হচ্ছে এই গোটা পৃথিবীটা হলো শুধু এই অন্ধকার বাক্সটা আর সেখানে ওরাই দুজন মাত্র জীবন্ত মানুষ। অথচ ওদের থেকে মাত্র কয়েক পদের দূরত্বে দেড় কোটি মানুষের কোলাহলে ডুবে আছে এই শহর। এভাবে কেটে গেলো আরও চারটি ঘন্টা। আচ্ছা এতোবড় ভবনে কেউ কি নেই? একটা মানুষও কি থাকবে না? এটা কিভাবে হয়? ঋজুর মাথায় এইসব প্রশ্ন ঘুরপাক করতে করতে সে ব্যাগ থেকে পথে কেনা বিস্কিটের প্যাকেট আর জলের বোতল বের করে রিনি দিকে এগিয়ে দিলো। বোতলে জলও বেশি অবশিষ্ট নেই। বিস্কিট টা না খেলেও জলের বেশিরভাগ খেয়েছিলো ওরা যাত্রাপথে। বিস্কিট আর জল টা রিনি দুজনের মাঝে ভাগ করে নিলো। আর মেয়েরা সংসারে অন্যকে বেশি দেবার যে সহজাত প্রবৃত্তি জন্ম নেই হয়তো সেখান থেকেই ঋজুকে বেশি দেবার চেষ্টা করলো।
সহ্যের শেষ সীমায় পৌছে গেছে ওরা। দীর্ঘ চুয়াল্লিশ ঘন্টা এই পাঁচ বাই ছয়ের অন্ধকার ঘরে আবদ্ধ থেকে নতুন এক যন্ত্রনা গভীরতাকে চিনতে শিখেছে যার সম্পর্কে এতদিন শুধু শুনেছিলো ওরা। আর সেটি হলো ক্ষুধা। তীব্র এক অনুভূতি পেটের ভেতর যেন নাড়া দিয়ে যাচ্ছে বার বার। যেন কুন্ডলী পাকানো এক শূণ্যতা পেট থেকে চিঁড়ে নিজেকে বের করে দিয়ে চাইছে। বিখ্যাত আলোকচিত্রী কেলভিন কার্টার অপেক্ষমান শকুনের সামনের যে ক্ষুধার্ত এবং মৃতপ্রায় সুদানি শিশুটির ছবি তুলেছিলেন আজ সেই শিশুটির ছবি ভেসে উঠলো রিনির চোখের সামনে। আজ ছবিতে দেখা ঐ শিশুটির যন্ত্রনা প্রকৃত অর্থে যেন ছুয়ে গেলো, শুধু ওর হৃদয়ে নয়, ওর পাকস্থলীতেও। পার্থক্য শুধু ওদের সামনে যে শকুন অপেক্ষা করে আছে সেটা হলো এই নীরবতা আর গাঢ় অন্ধকার।
নিজের ব্যাগে থাকা জামাকাপড় সব শেষ হয়ে গেছে। বন্দী থাকার একশো বাইশ ঘন্টা পর ওরা এবার নিজেদের পরনের জামা কাপড় ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে শুরু করলো। মানুষ প্রেমে পাগল হয়, বিশ্বাস ঘাতকতায় হয়, একাকীত্বে হয় কিন্তু তারা যদি জানত ক্ষুধার মানুষকে কতখানি উন্মাদ করতে পারে, ক্ষুধার আঘাত একজনকে কতটা অসহায় করতে পারে তাহলে ঐ সব ঠুকনো কারণে প্রাণ বিসর্জনের স্বাদ ঘুচে যেত ওদের। কাপড়ের শক্ত তন্তু ছিঁড়ে খেতে খেতে দুজনের মাড়িতে আচড় পরে গেছে। চুইয়ে রক্ত বের হচ্ছে অল্প অল্প। কিন্তু ক্ষুধা ওদের ক্ষমা করছে না। যেন প্রতি মূহুর্তে ক্ষত-বিক্ষত করছে শরীরটাকে । আর চারিদিকে ওদেরই বিষ্ঠা ছড়ানো। বিকট গন্ধে যেন হৃৎপিণ্ড বুকের খাঁচা থেকে মুক্তির খোঁজ করছে। ব্যাগের জামা-কাপড় শেষ হয়ে গেলে নিজের পরনের কাপড় ওরা ছিঁড়ে খেতে শুরু করলো। অবশেষে দেহের অন্তর্বাস বাদ গেলো না। বড় ক্ষিদে, বড় যন্ত্রনা। কি নিষ্ঠুর এই অন্ধকার কাঠামোটা। একটু একটু করে মৃত্যুকে মেনে নেয়া ছাড়া, আত্নহত্যা করারও কোন উপায় নেই।
এই বদ্ধ নরকে ওরা আছে প্রায় সপ্তাহ হতে চললো। রিনি কয়েক ঘন্টা জ্ঞান হারিয়েছে। হয়তো আর জ্ঞান ফিরে নাও পেতে পারে। ঋজু এখনো নিজের শরীরের বিরুদ্ধে গিয়ে টিকে আছে। তবে জীবনী শক্তি প্রায় যে শূন্যের কোঠায় সেটা প্রতিটা নিঃশ্বাসে টের পাচ্ছে ও। মৃত্যুকে মেনে নেবার পরেও মানুষের মনে কোথাও না কোথাও বেঁচে থাকার একটা তীব্র বাসনা বার বার ভেরতটাকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। ঋজুও সেই তীব্র আখাংকাকে নিয়ে শেষ বারের জন্য ঈশ্বেরর কাছে প্রার্থনা করছিলো হঠাৎ ওর দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো রিনি মুখের উপর। চোখ নিচে কালি পরে গেছে। গুলো এলোমেলো চুল, নগ্ন দেহটা এলিয়ে পরে আছে। রিনির শরীরটাকে এভাবে দেখার পর ঋজুর সহ্য সব সীমা পার হয়ে যাওয়া খিদেটা লোভের রূপ নিলো। নিজেকে কোন ভাবে যেন নিয়ন্ত্রন করতে পারছে না । এতো বছরের প্রেম, বিয়ে, বন্ধন সবকিছু মুখ থুবড়ে পরেছে এই নরকের দেয়া যন্ত্রনার কাছে। নিজের নিয়ন্ত্রন শক্তি হারিয়ে ঋজু ওদের ট্রলি ব্যাগের উপরে বিজ্ঞাপন হিসাবে এটে দেয়া ধাতব এবং ধারালো একটা ট্যাগ খুলে নিয়ে একটু একটু করে রিনির কাছে এগিয়ে গেল। ঠিক সেই মূহুর্তে রিনি চোখ খুলে তাকিয়ে পরলো ঋজুর দিকে। কিন্তু ঋজু এতটুকু বিচলিত হলো না। একটা সামান্য পশুর মত ঝাঁপিয়ে পরলো রিনির উপর। নিজের সমস্ত শক্তিকে এক করে রিনি গলায় সেই ধারালো ট্যাগ দিয়ে একেক পর পর আঘাতে গলার নালী বের করে ফেলল। দুর্বল রিনির কোন প্রতিরোধ কাজে এলো না। শুধু মৃত্যু পূর্বে হয়তো নিজের ভালোবাসার, সতীত্বের, বিশ্বাসের এই প্রতিদানে কিছুটা অভিমান নিয়ে চোখ বন্ধ করেছিলো, অবশ্য সে খবর কেউ রাখেনি। তৃষ্ণায় গলাটা শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেছিলো এই নতুন পশুটার। তাই পেট ভরে আগে গলা থেকে রিনির রক্ত ঢোক ঢোক করে গিললো। তারপর গলার কাটা স্থান থেকে নরম মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে লাগল। কখনো ধারালো ধাতবের ব্যবহারে, কখনো হাতে দিয়ে টেনে ছিঁড়ে রিনির নরম শরীরটার মাংসের টুকরো গুলো পরম তৃপ্তির সাথে গিলতে লাগলো। এভাবে গলা, স্তন, উদর, যোনী, উরু কোন কিছুই বাদ গেলো না । এমন কি মাথাটা আলাদা করে গলার পথে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রিনির মাথার ঘিলু নাগাল পাবার অবিশ্রান্ত প্রচেষ্টাও সফল হলো মানুষ থেকে পশু হওয়া এই নতুন স্বত্বা । অবশেষে পরে থাকলো শুধু শুকিয়ে যাওয়া মুখখানা। টিস্যুগুলোর সংকোচনে মুখখানা কেউ কেউ দেখলে মনে করতো কোন মুখোশ পুরনো হয় গেছে। ক্ষুধার যন্ত্রনা আবার নাড়া দিলে হাড়ের কাঠামোতে কোন মতে টীকে থাকা এই পচন ধরা মুখটাকে চিবুতে শুরু করলো ঋজু। চিবুতে চিবুতে শেষ যখন শেষ অংশ গিলে ফেললো ঠিক সেই সময় জ্বলে উঠলো লিফটের আলো, একটা পরিচিত শব্দে খুলে গেলো লিফটের দরজা।
পরিশিষ্ট
পরে জানা যায় ঐ ভবনটি রিনির সচিব চাচার ভবনের পাশেই অবস্থিত। ভুলে করে ওরা এই ভবনে ঢুকে পরে। অবৈধ নির্মাণ হবার কারণে ভবনটি রাজউক ভেঙ্গে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। কিন্তু আইনি জটিলতা শেষ হতে আরও কয়েকদিন সময়ের প্রয়োজন হয়। বাসিন্দারা সবাই চলে গেলে যেদিন ভবনের বিদ্যুৎ বন্ধ হবার কথা দুর্ভাগ্যবশত সেইদিনই ঋজু আর রিনি ঢুকে পরে অভিশপ্ত লিফটে। ঋজু এখনো বেঁচে আছে। শুধু উন্মাদ হয়ে গেছে। শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়। এখনো মানুষের রক্ত আর মাংস খাওয়ার মাঝে মাঝে চিৎকার করে, প্রায়ই করে হাহাকার।