Archive Pages Design$type=blogging

কালনাগিনী

বাংলাদেশের সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ কোনটি? ছেলে-বুড়ো সবাই চট করে বলে উঠবে– কালনাগিনী! কালনাগিনীর নাম শুনেই অনেকের গা শিউরে উঠতে চায়, গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়! অনেকে বিশ্বাস করেন, শুধু বাংলাদেশের নয়, পুরো পৃথিবীতে সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ কালনাগিনী। শুধু কি বিষাক্ত, কালনাগিনী হচ্ছে সাপদের রাণী; আর ভয়ঙ্কর রকম জেদী আর প্রতিহিংসাপরায়ণ। কোন মানুষ যদি কালনাগিনীর সঙ্গী বা আত্বীয়কে মেরে ফেলে বা আঘাত করে তবে কালনাগিনী তার প্রতিশোধ নিবে। কালনাগিনী শত্রুকে চিনে রাখবে এবং শত্রু যত দূরে যেখানেই পালাক না কেন যত দিন পরেই হোক না কেন কালনাগিনী অবশ্যই তার প্রতিশোধ নিবে!
.
আসলে এসব তথ্যের সবই মিথ্যা আর মানুষের ভুল বিশ্বাস। কালনাগিনী পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ নয়। সবচেয়ে চমকে দেয়ার মত তথ্য হচ্ছে, কালনাগিনীর সামান্য একটু বিষ আছে, আর সে বিষও এত নিরীহ প্রকৃতির যে মানুষের কোন ক্ষতিই হয় না! এজন্য কালনাগিনীকে সাধারণত নির্বিষ সাপ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কালনাগিনী সাপদের রাণী নয়। আসলে সাপদের কোন রাজা-রানী থাকে না। শুধু কালনাগিনী কেন, পৃথিবীর সব সাপের স্মৃতি শক্তি বেশ দুর্বল। অন্যান্য আর দশটা সাপের মত কালনাগিনীও কাউকে চিনে রাখতে পারে না। কোন সাপেরই 'প্রতিহিংসা' নামক অনুভূতি নেই যে তার শত্রুকে খুঁজে বের করে প্রতিশোধ নিতে পারে। কালনাগিনী ভয়ঙ্কর রকম জেদী আর প্রতিহিংসাপরায়ণ তো নয়ই, বরং মজার ব্যাপার হচ্ছে, কালনাগিনী অন্যান্য সাপের চেয়ে একটু বেশী ভীতু আর 'নার্ভাস টাইপ' সাপ! অল্প ভয় দেখালেই এরা পড়িমড়ি করে এঁকেবেঁকে ছুটে পালায়।
.
কালনাগিনী যদি এত নিরীহই হবে তাহলে বাংলাদেশের মানুষ কেন কালনাগিনীকে এত ভয়ঙ্কর ভাবে? বাংলাদেশের এত এত মানুষ সবাই কি তাহলে ভুল করছে? এর মূল কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন লোকগল্পে কালনাগিনীকে ভয়ঙ্কর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। 'বেহুলা-লক্ষীন্দর' কাহিনিতে কালনাগিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সেখান থেকে প্রভাবিত হয়ে সাপুরেরাও কালনাগিনীকে ভয়ঙ্কর হিসেবে প্রচার করে। তারা এটা করে ইচ্ছে করে– তাদের তাবিজ কবজের বিক্রি বাড়ানোর জন্য। যদিও সাপুরেরা ভালো করেই জানে কালনাগিনী সাপের বিষ নেই। লোকগল্প আর সাপুরেদের প্রচারে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনে কালনাগিনী সম্পর্কে যে ভীতিকর আর সমীহ জাগানিয়া আবহের তৈরি হয়েছে, সেটাকে কাজে লাগিয়ে সিনেমা হিট করার জন্য বেশ কিছু সিনেমা তৈরি হয়েছে কালনাগিনীকে নিয়ে, যেগুলোতে কালনাগিনীকে সাপদের রানী, ভয়ঙ্কর বিষাক্ত, জেদী আর প্রতিহিংসাপরায়ণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের আপাময় জনসাধারণের মনে কালনাগিনী সম্পর্কে ভুল তথ্য আর ভুল বিশ্বাস ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যাপারটা এতটাই খারাপ পর্যায়ে গেছে যে, আমাদের দেশে কুটিল আর ভয়ঙ্কর চরিত্রের মেয়েদের কালনাগিনী বলে উল্লেখ করা হয়। :p
.
কালনাগিনী সাপ দেখতে অনেক সুন্দর! অনন্য সৌন্দর্যের কারণে কালনাগিনীকে সহজেই চেনা যায়। তুলনামূলকভাবে অন্য সাপের চেয়ে সরু এই সাপটি বেশ রঙ্গিন। মাথা ছোট, চ্যাপ্টা; গলা চিকন। সাদা বা সবুজাভ হলুদ দেহের উপর কালো ডোরা কাটা। তার উপর পিঠ জুড়ে লাল আর কমলা রঙের ফুলের মত সুন্দর নকশা করা। এরা বেশ চঞ্চল প্রকৃতির। গাছের উপর থাকতে ভালোবাসে। ঝোপঝাড়ে, গাছের এক ডাল থেকে আরেক ডালে খুব দ্রুত চলাচল করতে পারে। শিকার ধরার জন্য বা ভয় পেয়ে পালানোর সময় দ্রুত চলতে গিয়ে উঁচু ডাল থেকে নিচু ডালে লাফ দেয়, এমনকি এক গাছের উঁচু অংশ থেকে আরেক গাছের নিচু অংশে লাফ দিতে পারে। দেখে মনে হয় যেন উড়ছে। এ জন্য কালনাগিনীর ইংরেজি নামই হয়ে গেছে 'Ornate Flying Snake' বা উড়ুক্কু সাপ। কালনাগিনীর বৈজ্ঞানিক নাম Chrysopelea ornate. অনেক সময় দ্রুত চলতে গিয়ে এরা গাছ থেকে ঝুপ করে নিচে পড়ে যায়।
.
এশিয়ার দক্ষিণের দেশেগুলোতে (বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়শিয়া, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, হংকং,, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইন) এরা বসবাস করে। বাংলাদেশের সিলেট, চট্রগ্রাম এবং সুন্দরবনে এদের বেশী দেখা যায়। কালনাগিনী যে কোন গাছ বেয়ে উঠতে পারে। এমনকি নারকেল গাছের মত খাড়া গাছেও এদের প্রায়ই পাওয়া যায়। এরা খসখসে যে কোন কিছু বেয়ে উঠতে পারে। কালনাগিনীকে কখনও কখনও দেয়াল টপকাতেও দেখা যায়। গাছে বাস করে এমন ছোট প্রানী – টিকটিকি, বাদুর, ইঁদুর কাঠবিড়ালী কালনাগিনীর পছন্দের খাবার। এরা কখনও কখনও পাখির ডিম আর কীটপতঙ্গও খেয়ে থাকে। ইঁদুরের মত খাবারের জন্য কখনো বাড়িঘরেও ঢুকে পরে। এজন্য অনেক সময় এদেরকে ফসলের ক্ষেতে, বাড়ির ফুল বাগানে বা টবে দেখতে পাওয়া যায়।
.
কালনাগিনী সাপ এত নিরীহ, শান্ত স্বভাবের আর এত সুন্দর দেখতে যে, অনেকে কালনাগিনী সাপ শখ করে পুষে থাকেন। এই শখের ফলে যে চাহিদা তৈরি হয়েছে তা মেটাতে ভিয়েতনাম এবং এর আশেপাশের দেশগুলোতে প্রচুর কালনাগিনী সাপ পাচার হয়। কালনাগিনী সাপের অস্তিত্বের জন্য এটাই এখন অন্যতম বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।

COMMENTS

Name

আমার ভাবনাগুলো
false
ltr
item
Omonibus: কালনাগিনী
কালনাগিনী
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhCZlE1CNSPfeYR7uN_jI7lpcbx8D6muneRVEMcDQBb3nWhGhLH9otO76dtdn4_XkSaVnEO4GvahXA-izf7p3NgAiTc2XHwfjUhnsfxW0IcAglbb1Azd8Ysnhz-g38IUtmIpFEikVW8ECrO/s320/image1-782334.JPG
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhCZlE1CNSPfeYR7uN_jI7lpcbx8D6muneRVEMcDQBb3nWhGhLH9otO76dtdn4_XkSaVnEO4GvahXA-izf7p3NgAiTc2XHwfjUhnsfxW0IcAglbb1Azd8Ysnhz-g38IUtmIpFEikVW8ECrO/s72-c/image1-782334.JPG
Omonibus
http://omonibus.blogspot.com/2016/09/blog-post.html
http://omonibus.blogspot.com/
http://omonibus.blogspot.com/
http://omonibus.blogspot.com/2016/09/blog-post.html
true
1459505652775704545
UTF-8
Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago